সারা বিশ্বে শান্তি, স্বস্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা

 

তোমাদের শান্তিকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি; আমার শান্তি আমি তোমাদেরকে দিব। বৈশ্বিকভাবে যে শান্তি তোমরা কামনা করছ আমি সে শান্তি দিব না। তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হইও না। - জন — ১৪:২৭

পরিবার-গৃহ-সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব যেখানেই বলি, সম্প্রীতি না থাকলে কোথাও শান্তি বা উন্নয়ন আসতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে সম্প্রীতির উৎস কোথায়; এককথায় উত্তর সহিষ্ণুতায়, পরমতসহিষ্ণুতায়। এই সত্যের কথা জেনেও আমাদের সমাজের বাস্তবতা আজ ‘বিচার মানি, তালগাছ আমার।’ সমাজের এই নড়বড়ে অবস্থায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, পরিবারে পরিবারে, মহল্লায় মহল্লায়, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, দলে দলে এমনকি ধর্মে ধর্মে যদি সম্প্রীতি সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।সুন্দর ও মানবিক জীবনযাপনের জন্য ‘শান্তি’ মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে অদৃশ্যভাবে প্রেরণা যোগায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক বিষয় বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার তন্মধ্যে ‘শান্তি’ অন্যতম।

বিশ্বে শান্তি,স্বস্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ধারণা ও ইতিহাস: বিশ্ব শান্তি বা বৈশ্বিক শান্তি বলতে সমগ্র বিশ্বের সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যকার শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে বোঝায়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং ফলস্বরূপ জন্ম হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের। এটি ছিল এমন একটা বৈশ্বিক সংস্থা যাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্য শান্তি, একতা, সমঝোতা ও মিত্রতা ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর উত্তরসূরী হিসাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতিসংঘই বিশ্বের প্রথম আন্তঃদেশীয় সংস্থা যেটি এখন পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থে বিশ্ব শান্তি ধরে রাখতে সফল হয়েছে।

তবুও এটা পুরোপুরিভাবে বলা যাবে না যে বিশ্ব শান্তি অর্জিত হয়েছে। কারণ প্রত্যেক জাতি ও দেশের মধ্যকার সংঘাতহীন শান্তি পূর্ণ পরিস্থিতি ও সম্পর্ককেই বিশ্ব শান্তি বলা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো বৃহৎ বৈশ্বিক যুদ্ধ না হলেও আঞ্চলিক কিছু যুদ্ধে পরাশক্তি[ক] রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণ বিশ্ব শান্তিকে সাময়িক বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রাজনৈতিক টানপোড়ান ও অস্থিতিশীলতা বিশ্ব শান্তি বিনষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ। এক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেকসময় একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক কোন্দলে পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধ।

তবুও অনেকে মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকাংশেই স্থিতিশীল হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগতি (যেমন, মহাকাশ প্রতিযোগিতা) ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই (সোভিয়েত সাম্রাজ্য ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ) হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন সাম্রাজ্যবাদ থেকে দূরে সরে থাকা দেশগুলো নিজেদেরকে বিশ্বের সম্মুখে প্রতিষ্ঠা করার একটি সুযোগ পেয়েছে। বলা যায় একপ্রকার "সমতা আনায়ন" হয়েছে বা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ সমকক্ষ দেশ ও জাতি যুদ্ধ ও অশান্তির মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বদলে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

সৃষ্টিগতভাবে মানুষ শান্তিপ্রত্যাশী হলেও, চাইলেই শান্তি মেলে না। তবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানবতার ধর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা ধর্মে কোনো শ্রেণি বৈষম্য নেই। ধর্ম শ্রেণিবিভেদকে সমর্থন করে না। ধর্ম মানুষকে সহনশীল করে, ভালোবাসতে শিখায়। আর এ কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

পৃথিবীর ইতিহাসের নানা বাঁকে, যুগে যুগে অনেকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন ও কর্মসূচি দিয়েছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত শান্তি মেলেনি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শান্তি মিশন। তিনি মানুষের সামগ্রিক জীবনের প্রতিটি ধাপে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে চিন্তায় কর্মপদ্ধতি প্রদান করে গেছেন। সমকালীন মানুষসহ কিয়ামত অবধি আগত মানুষকে তিনি দিয়ে গেছেন কাঙ্ক্ষিত শান্তির সন্ধান। মানবজীবনে যেসব পথে অশান্তি আসতে পারে, তিনি সেগুলো বন্ধ করেছেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদে থাকে। ’

সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে তিনি যেসব মূলনীতি ঘোষণা করেন, সেগুলো হলো- বর্ণ বৈষম্য নিষিদ্ধ করা, ন্যায়সঙ্গত বিচার করা, বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা, জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা, দরিদ্র-অভাবীদের ধনীদের সম্পদে অধিকার দেওয়া, বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা, জীবন-সম্মান ও সম্পদ রক্ষার নিশ্চয়তা, চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সহনশীল হওয়া। এখানে উল্লেখিত বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে মানা হলে আজও অশান্ত এই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

আসলে সমস্যাসঙ্কুল এই বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকারবঞ্চিত, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ, ঝরছে নিরীহ মানুষের রক্ত, যেখানে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুপম জীবনাদর্শ এবং সর্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই বহুপ্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। গড়তে পারে নিরাপদ, সংঘাতমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী।

চিন্তা করলেই পরিলক্ষিত হবে যে, পৃথিবীতে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো, ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা, সুশাসন ও জাতীয় ঐক্যের অভাব এবং ইতিহাস বিমুখতা।সৃষ্টির সেরা মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে, নীতি-নৈতিকতা ভুলে যায়, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে লিপ্ত হয়- তখনই শান্তি বিনষ্ট হয়। আসলে সামাজিক ভেদাভেদ, পেশী শক্তির মহড়া থেকে মুক্তি পেতে হলে মানুষের মাঝে পরস্পরে হিংসা-মারামারি ও শত্রুতার দেয়াল ভাঙতে হবে।পাপ-পঙ্কিলতার পথ পরিহার করতে হবে।

পৃথিবীতে  শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে-নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ বাড়াতে হবে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত- জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। পৃথিবীতে শান্তি, স্বস্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় যেসব আইডিয়া কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তা নিম্নরূপ:

ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া: ভ্রাতৃত্বের মৌল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা। আর ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা’র মৌল ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তা নির্বাচন করা।

প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করা: বিতর্ক করা হবে সত্য প্রকাশ ও মানুষের প্রতি দয়া-মমতার জন্য। বিতর্কে একপক্ষ অপর পক্ষকে মূর্খ বা অজ্ঞ বলে থাকে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যদি মূর্খও হয় তবুও তাকে তা বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং না বলাটাই প্রকৃত শিক্ষা।

কারো ওপর জুলুম না করা: ন্যায়বিচারের বিপরীত হলো জুলুম। যার যা প্রাপ্য তাকে তা না দেয়া হলো জুলুম। একে অবিচারও বলা হয়। অবিচার হলো বড় জুলুম। অবিচারের মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। জুলুম বা অত্যাচার হলো কারও প্রতি অন্যায় আচরণ করা। এটা ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ, শারীরিক আক্রমণ বা সম্মানহানির মাধ্যমেও হতে পারে। অন্যের উপর জুলুম না করার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা হবে।

সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজের নিষেধ করা: বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এটি একটি অত্যবশ্যকীয় দায়িত্ব। এর মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। যিনি আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেন তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক।

জবাবদিহিতার মানসিকতা থাকা: সমাজে প্রত্যেক মানুষ তার কর্মফলের জন্য নিজেই দায়ী। কোনো লোকের দুর্নীতি, অপকর্ম বা পাপে অন্য কেউ বা তার আত্মীয়স্বজন বা বংশ দায়ী হবে না। মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশের উপযুক্ত তত্ত্ব-তথ্য, আয়-ব্যয়, হিসাব-নিকাশ ও লেনদেনকে সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য উন্মুক্ত করাই হলো স্বচ্ছতা। আর প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজ নিজ অধীন ব্যক্তিদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়াই জবাবদিহি। জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুপ্রস্থ করবে।

নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করা: খেলাধুলা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অভিমত দিয়েছেন কয়েজন গবেষক। দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে খেলা দেশগুলোর মধ্য একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঠিকই, কিন্তু খেলাধুলা একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী হেরে গেলেও তা যুদ্ধের থেকেও অধিক মান্য।

প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার কুরুচিপূর্ণ সম্পর্ককে অলিম্পিক খেলা অনেকাংশে লাঘব করেছিল। এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা হতো ঠিকই, কিন্তু তা হতো একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ভিতরে, ফলে হারলেও হেরে যাওয়া পক্ষের কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ থাকতো না। তৎকালীন অলিম্পিক গেমস দেবতা জিউসের সম্মানে খেলা হতো তাই হেরে যাওয়া পক্ষের তখন নিয়ম ভঙ্গ করে যুদ্ধ ঘোষণার সাহস ছিল না।

প্রকৃত শিক্ষা অর্জন নিশ্চিত করা: উপর্যুক্ত শিক্ষা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তি (রাষ্ট্রপ্রধান) বা জাতি অপর জাতির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে উভয় দেশের মধ্যকার শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করতে চাবে না। আপাতদৃষ্টিতে এতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতি বিদ্যমান। শুধুমাত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ-সংঘাত থেকে বিশাল পরিমাণ আর্থিক ও সামরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষার ফলে মানুষ তুলনামূলক জ্ঞান লাভ করে। ফলে সে সহজেই তুলনা করতে পারে কি খারাপ আর কি ভালো। যুদ্ধ-সংঘাতের ক্ষতির দিকটি তার নিকট স্পষ্ট থাকে। এছাড়াও শিক্ষিত ব্যক্তি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপে নিজেকে নিয়োজিত করে পারে, যেমন- রাজনৈতিক আন্দোলন।

বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা নিশ্চিত করা: বিশ্ব শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য আঞ্চলিক ও আন্তঃদেশীয় সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেমন, জাতিসংঘ, সার্ক, ওআইসি, আসিয়ান, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন ইত্যাদি। এগুলোর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মাঝের শান্তি, সম্প্রীতি ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা। এই কাজ করতে গিয়ে কিছু সংস্থা সামরিক আশ্রয়ও গ্রহণ করে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন তন্মধ্যে প্রধান।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণে যে স্বপ্ন ছিল বাঙালির জন্য, সেই স্বপ্নকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশ আজো উন্নয়নের সরণিতে পথ চলতে সচেষ্ট আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কোনো বিকল্প আজো তৈরি হয়নি আমাদের জাতীয় জীবনে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল বাঙালি জাতিরই নন, তিনি ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের মুক্তি ও শান্তির দূত। তিনি তার এক ভাষণে বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত—শোষক ও শোষিত। আমি শষিতের পক্ষে। তিনি সব সময় শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়ত মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিশ্ব শান্তির জন্য কাজ করেছিলেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ জাতির পিতাকে 'জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার'-এ ভূষিত করে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু ২৫ সেপ্টেম্বর ভাষণ দেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, 'সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরীতা নয়' এই নীতি তিনি ঘোষণা করেছিলেন। যে নীতি আমরা এখনো মেনে চলি। বাংলাদেশ সব সময় চায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। যুদ্ধ না, আমরা শান্তি চাই। সংঘাত না, আমরা উন্নতি চাই।  জাতির পিতার শান্তি সেনানীরূপে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় 'ব্লু হেলমেট' পরিবারের সদস্য হয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে গত ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি শান্তিরক্ষী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। সমগ্র বিশ্বে শান্তিরক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বজনবিদিত।

শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অর্থনৈতিক অসমতা। দেখা যায়, যে অধিকাংশ রাষ্ট্রই সামরিকভাবে শক্তিশালী হলেও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। ফলে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখনও অনেক দেশ যুদ্ধকেই বেছে নিচ্ছে। এছাড়াও সীমান্ত জটিলতা বিশ্ব শান্তির সামনে একটি প্রধান বাধা। সমঝোতা বা মীমাংসায় কাজ না হলে প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যার কোনো বিকল্প নেই। সেখানে আবার পরাশক্তিগুলো জড়িয়ে পরলে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘাত, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত সংঘাত এবং ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত বর্তমানের কিছু প্রধান ও আলোচিত সীমান্ত সমস্যা, যেখানে পূর্বেও পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপে যুদ্ধ সংঘটনের ইতিহাস আছে।

ধর্মীয় ও জাতিগত অসমতা বিশ্ব শান্তি বিনাশের অন্যতম কারণ। এটি কোনো অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনাশেরও কারণ। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা যুদ্ধ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এছাড়াও আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধও জাতিগত সংঘাতের ফলেই হচ্ছে। দেশের প্রধান ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রভাব বিস্তার এবং একই সঙ্গে বিদেশি হস্তক্ষেপ এর প্রধান কারণ। একটি ধর্মীয় সংঘাত ব্যাপক আকার ধারণ করলে তা আরও বহু দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ একই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্বধর্মীদেরকেই সমর্থন দিবে। বিনিময়ে বিপক্ষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ও স্থিতিশীল কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হবে। এই কারণেই অধিকাংশ মুসলিম দেশের সঙ্গে ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসরায়েল রাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ।

তবুও আশার আলো এই যে, সম্মেলিতভাবে যথাপোযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এসব প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিহত করে বিশ্বে শান্তি, স্বস্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।


Comments